Ghost, Short Story

ভূত বাংলো

ডায়মন্ড হারবার। তিন বন্ধু বেড়াতে এসেছি। উঠেছি এক বাংলোতে। বাংলোর কেয়ারটেকার মনোহর। দেখলে মনে হয়, কোন মিশমিশে কালো গরিলার অনাহারে বুঝি হাড় জিরজিরে চেহারা হয়েছে। আর হাসলে যেন মনে হয় এক গোছা মুলো যেন দাঁতের জায়গায় বাঁধিয়ে বসেছে!
শীতকাল। এতটা পথ আসার ধকলে, ঠাণ্ডা হাওয়া লেগে গলাটা বেশ খুসখুস করছিলো। উঠে রান্নাঘরে এলাম। রান্নাঘরটা মোটামুটি অন্ধকার। উনুনের হলদে-লাল আগুনটা কেবল অন্ধকারের গায়ে একধরনের উজ্জ্বল আস্তরণ ফেলেছে।
রান্নাঘরের চৌকাঠের উপর দাঁড়িয়ে মনোহরকে বললাম, ‘মনোহর গলাটা বেশ খুসখুস করছে, এক গেলাস নুন-গরমজল করে দিতে পারো?’
টিনের দরজা খোলার সময় যে ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ হয়, ঠিক সেই রকম আওয়াজে মনোহর হাসতে হাসতে বলল,’জানেন বাবু, আমাদের গাঁয়েতে সবাই বলে, সামুন্দরের পানি শামশানের জ্বলন্ত চিতাতে গরম করে গারগেল করলে সব গলা ব্যথা ছুঁমন্তর।’
আমি হাসতে হাসতে বললাম,’ তুমিতো বেশ মজা করো!

আচ্ছা মনোহর, সবাই বলছিল এই বাংলোটা নাকি ভূত বাংলো?’

মনোহর:’ কাহে সবলোক ইয়ে সব বোলতে হ্যাঁয়! হামি তো কতো সাল সে এখানেই আছি।’
বলা শেষ হওয়া মাত্রই আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। মনোহরের ডান হাতটা হঠাৎ দক্ষিণের জানলা দিয়ে ক্রমশ লম্বা হতে-হতে বেড়িয়ে গেল, আবার দু-সেকেন্ডের মধ্যে হাতটা ফিরে এলো, হাতটাতে তখন এক গ্লাস ফুটন্ত গরমজল, আমার দিকে বাড়িয়ে বলল,’বাবু, সামুন্দরের পানি, চিতার আগুনে গরমভি করিয়েছি, গারগেল করিয়েলিন গলা ব্যথা ছুঁমন্তর হয়ে যাবে!’
বলেই আবার সেই ক্যাঁচক্যাঁচ করে হাড়ে হিম ধরানো হাসিটা হেসে উঠলো।
Awareness, Flash Fiction, Life, Short Story, Social Issues, Way of Life, Women

সেই গলিটায়, শুধু লাল আলো খেলা করে

-বাবা, ঐ গলিটার ভিতর দিয়ে কোথায় যাওয়া যায়?
-ঐ গলিটা কোনো পথ নয়। ঐ গলিটার ভিতরে গেলে মানুষ হারিয়ে যায়।
-কিন্তু…
-কিন্তু নয় তাড়াতাড়ি পা চালাও, বাড়ি পৌঁছাতে হবে।

লাল গলিটা। লাল রঙ আমাদের খুব টানে। খুব। তাই না!

বাবার সঙ্গে সেই কথা গুলোর পর দশটা বছর কেটে গেছে… এখন দশম শ্রেণী। সেদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় একটা ঝাঁপিয়ে পড়া অন্ধকার, সব যেন শূন্য করে দিলো।
যখন জ্ঞান এলো, চোখে পড়লো একটা অদ্ভুত রঙচঙে ঘর তাতে সেই লাল আলো… কি মায়াবি… আর কতো গুলো রঙ মাখা মুখোশ… না মুখ! বোঝা যায় না ভালো করে! সব ঝাপসা। সবাই ওখানে মহিলা, এটা বোঝা যায়।
‘কে তোমরা? এটা কোন জায়গা?’
-‘মেলা ফ্যাচ-ফ্যাচ না করে তৈরি হ, লোক পাটাচ্ছি’
মুখে গোজা একদলা পান, বাঁকা ঠোঁটটার কোণা দিয়ে ছিটকে আসছে কথা গুলো, অচেনা মুখ,এরকম অভিব্যক্তির সাথে সে পরিচিত নয়।মাথাটা এখনো ঝিমঝিম করছে। অন্য আরেকটা কণ্ঠস্বর পরিবেশের ছন্দপতন করলো।

-‘এই, তোরা ঘরটা খালি করতো, নতুন পাখিকে দেকি একবার বালোকরে।’ কথা গুলো যার থেকে এলো সে হলুদ শাড়ি পড়েছে। মাঝবয়েসী বাকিদের তুলনায় বড়ো। মুখ গুলো এখনও কেমন ঝাপসা লাগছে। তার কথায় সবাই বেরিয়ে গেলো।
দরজা বন্ধ হলো। এখন ঘরে শুধু হলুদ শাড়ি পড়া মহিলা।

-‘পালিয়ে যা! এক্কুনি পালা! বাজার নষ্ট করতে এসেছিস না!’ দাঁতে দাঁত চেপে রেগে রেগে খুব চাপা স্বরে বললো। একটু থেমে, ‘বয়েস কতো?’
-‘ষোলো। আমি বাড়ি যাবো! আমায় বাড়ি নিয়ে চলো!’
বিরক্ত হয়ে বললো, ‘উঃ! এপথে এচিলিস কেন!’ আবার নিচু গলায় বলে উঠলো,’শোন, যা বলছি তাই কর…’

ঘরের আলমারি থেকে বেরহলো হরেক রঙের শাড়ি, সব রঙের উপর একটা লালচে আভা পড়েছে, তাই হারিয়ে গেছে আসল রঙ। গিঁট বেঁধে বেঁধে জানলার শিকের সাথে বাঁধলো। নিজে বেরিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো সেই জানলার নিচে, পিছনের রাস্তায়, মেয়েটা শাড়ি বেয়ে নেমে গেলো।

মহিলা একটা গলি দিয়ে বের করলো মেয়েটাকে, ছুড়ে ফেলে দিলো ঝকঝকে একটা রাস্তায়। সেই রাস্তাটা। সাদা ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ঝলমল করছে পথঘাট। চেনা রাস্তা। মেয়েটা পিছন ফিরে একবার তাকালো যে গলি দিয়ে তাকে হলুদ শাড়ি পরা নারী বের করে দিয়েছে সেই গলিটার দিকে। গলিটা সেই লাল আলোর রাংতায় মোড়া। একই ভাবে মায়াজাল বিস্তার করছে। তাকে বের করে দিয়ে হলুদ শাড়ির নারী মূর্তি ফিরে যাচ্ছে সেই লাল গলির ভিতরে। মায়া গলি। মেয়েটা দেখলো, নারীর হলুদ শাড়ির আঁচল ক্রমশ মিলিয়ে ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে লাল আলোর ভিতর। লাল আলোটা যেন গিলতে পারে অন্য রঙকে, এমনই মায়া তার।

সেই লাল আলো, যার ভিতর হারিয়ে যায় অনেক রঙ, অনেক মানুষ আর অনেক অনেক রঙিন শাড়ি।

Awareness, ডাইনি প্রথা, Flash Fiction, Independent Woman, Life, Short Story, Social Issues, Witch, Woman

ডাইনি

একটা ভাঙাচোরা মুখ। অনেক গুলো চিড় খাওয়া একটা আয়নার সামনে, মুখটা মাঝেমাঝে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখছে নিজের অসংখ্য প্রতিফলন। ক্রমে দেখতে দেখতে নিজেকে কেমন অপদেবতা বলে মনে হচ্ছে!
গ্রামের লোকেরা যেটা বলে সেটা কি সত্যি! সত্যি সে…
না একবার সে বাঁচতে পেরেছে তাই বলে নিজেকে বারবার বাঁচানো সম্ভব না। তাকে পালাতে হবে, যে করেই হোক।
হঠাৎ তাকে চমকে দিয়ে দরজায় আঘাত পড়লো, ‘এই ডাইনি দরজা খোল! শহর থেকে লেখাপড়া করে, এখন এ গাঁয়ে এসেছিস ছোট ছেলেদের প্রাণ নিতে! তোর জন্যে নিবারণের ছেলে মরেছে ডাইনি, আজ তোকে পুড়িয়ে মারবো! দরজা খোল, নইলে ভেঙে ফেলবো দরজা!’ মেয়েটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। দরজায় করাঘাত উত্তরোত্তর বাড়ছে।
-‘কিরে খুলবি দরজা! নাকি ভাঙবো!’
-‘মোড়লমশাই আপনি অনুমতি দিলে ভাঙি।’
শুরু হলো দরজা ভাঙার শব্দ।
এক সময় দরজা ভেঙে গেলো। গোটা গ্রাম ঘরের ভিতর হুড়মুড় করে ঢুকতে গিয়ে, ঘরময় ছড়ানো আয়নার কাচ, ক্ষতবিক্ষত করে দিলো তাদের পা গুলোকে। মেয়েটা পালানোর আগে ভাঙা আয়নার কাচ ছড়িয়ে গিয়েছিলো ঘরময়। পিছনের জানলার শিক উপড়ানো।
-‘পালিয়েছে!’
-‘ডাইনি ধরতে হবে! চল শিগগিরি!’
আহত পায়ে কতক্ষনই বা খোঁজা সম্ভব!

ততক্ষণে মেয়েটি পাড়ি দিয়েছে অনেক দূরে, শহরের দিকে, যেখানে কেউ চেনে না তাকে, কেউ তাকে ডাইনি বলবে না, অকারণে দোষ দেবে না।

অন্তত একজন নারী এমন কলমের টানে ‘ডাইনি’ অপবাদ থেকে বাঁচুক।

Flash Fiction, Philosophy, Short Story

ভাষা ভাসাই পাহাড়ী অঞ্চলে

শিশু রোদ হেঁটে যায় বারবার।
নিরক্ষর হওয়া খেলে যায় দুরন্ত গতিতে।
তবু সে পাহাড়ের ঘুম ভাঙে না।
কেবলই পাতলা-তীক্ষ্ণ শব্দবাণ ছুড়ে চলি আমি।
পাহাড় শুধুই ফেরত পাঠায়
একগুচ্ছ মৃত অনুরণন।
কারণ,
পাহাড়ের হৃদয়ে লেগে আছে গাঢ় বুনো গন্ধ।
আর আমি?
আমি তো শুধুই শহুরে উপন্যাসের এক চরিত্র।

রবি ঠাকুর, Flash Fiction, Philosophy, Rabindranath Tagore, Short Story

আমার রবিঠাকুর

rabindranath-alongwith-elder-daughter-madhurilata-and-elder-son-rathindranath-300x300.gif

ঘরে ফিরে দেখি, সোফার উপরে বসে আছে রবিঠাকুরের বেশধারী এক ছদ্মবেশী। আমার তো দেখেই চক্ষুচরক গাছ! আজ বাড়িতে কেউউ নেই। অর্থাৎ বাড়িতে এখন আমি আর ছদ্মবেশী!

– কে আপনি! আমি কিন্তু চেঁচাব…                                                                                                           -‘আহা! দিঠি, শান্ত হও। ‘কে আপনি!’ আমায় চিনতে পারছ না!’

সেকি! লোকটা আমার নামও জানে! আপাদমস্তক আলখাল্লায় ঢাকা সেই গোঁফ, সেই দাঁড়ি। চোখ দুটো সপ্রতিভ। একে ভেকধারী বলি কি করে!

– না ! আমি চিনব কি করে! এই দিন দুপুরে রবিঠাকুরের মতো গোঁফ-দাঁড়ি লাগিয়ে, আলখাল্লা পরে মানুষের বাড়িতে ঢুকে বসে আছেন আপনি কিসের উদ্দেশ্যে!? আচ্ছা, সব দরজা জানলা তো বন্ধই আপনি ঢুকলেন কি করে!?                              -‘আমি যেখানে চাই সেখানেই যাই। বাধা কিসের!’                                                                                                  -বললেই হল! আপনি কি অ্যামিবা নাকি লাল পিঁপড়ে যে চাইলেই ফাঁক-ফোকর দিয়ে ঢুকে পড়বেন! বেড়িয়ে যান বলছি! বেড়িয়ে যান! আমি কিন্তু চেঁচামিচি করব। পুলিশ ডাকব।                                                                                     -‘হা! হা! হা!’                                                                                                                                                    – আপনি হাসছেন!                                                                                                                                            – ‘সবাই কি আর আমায় দেখতে পায়, দিঠি!’                                                                                                            – দেখতে পায় না মানে!

এবার উঠে গিয়ে বুকশেলফের কাছে গিয়ে বই দেখতে দেখতে বললেন—

‘হ্যাঁ… আমায় সকলে দেখতে পায় না। শুধু তারাই দেখতে পায় যারা আমার আত্মার সুর-তরঙ্গটাকে অনুভব করতে পারে।  তোমার খাটের উপর দেখলাম দুটো সমরেশের বই একটা তিলোত্তমার বই পড়ে আছে। এখন কে কেমন লেখে কখনও তো পড়িনি, জানি যদিও তুমি কাউকে তোমার বই পড়তে দাও না, তবু চাইছি দেবে পড়তে?’

আমি হতভম্ব হয়ে শুনছিলাম। এবার জোরে একটা চিৎকার আমার গলা থেকে বেড়িয়ে এলো।

– ও চৌধুরী কাকিমা দ্যাখো না আমাদের বাড়িতে….

-‘চিৎকার করে কোনও লাভ হবে কি! পাশের বাড়িতে তো মস্ত তালা ঝুলছে।’

আমি তাকিয়ে দেখলাম সত্যিই তাই। হঠাৎ ভয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লাম মেঝের উপর, হাউমাউ করে কাঁদতে-কাঁদতে বললাম আপনি কে আমি জানি না। কি উদ্দেশ্যে ঢুকেছেন আমি জানি না প্লিজ প্লিজ আপনি বেড়িয়ে যান।বিশ্বাস করুন আমার কাছে কটা দশ-কুড়ি টাকার নোট ছাড়া আর কিচ্ছু নেই।

-কাঁধ ধরে বলল ‘ওঠো ওঠো দিঠি। রোজরোজ আমার ছবির সাথে কথা বলো দিঠি। রোজ বলো আবার এসো রবিঠাকুর, বাংলা ভাষা যে বড়ো সংকটে। তাই তো এলাম। তোমার ডাকেই এসেছি। তুমি যখন বলছ তাহলে চলে যাচ্ছি। তুমি আমায় চিনতে পারছ না এটা খুব-ই দুঃখজনক ব্যাপার।’

আরে আমি যে রাতের বেলা রবিঠাকুরের ছবির সামনে বসে কথা বলি সেটা তো আমি আর আমার ঘরের জড়বস্তু গুলো ছাড়া আর কেউ জানে না।

-আপনি যে রবিঠাকুর অন্যকেউ নন তার প্রমাণ কি আছে?                                                                                    -‘তোমার প্রমাণ লাগবে দিঠি!’                                                                                                                             – তা তো লাগবেই একজন ব্যক্তি যিনি ৭৮ বছর আগে মারা গেছেন উনি কি করে ফিরে আসেন এইভাবে!                        -‘বেশ বলো কি প্রমাণ চাই!’                                                                                                                                -আমি গীতবিতান থেকে পেজনাম্বার বলব আর তাতে কি গান আছে সেটা আমায় গেয়ে শোনাতে হবে।                            -‘ বেশ। তবে সব তো মনে থাকে না। তবু বলো দেখি।’

হাতে গীতবিতান নিলাম, নিয়ে শুরু করলাম।                                                                                                    -৩০৫                                                                                                                                                           -‘হৃদয়ের   এ কূল,    ও কূল,    দু কূল ভেসে যায়,    হায় সজনি,                                                                                                                       উথলে নয়নবারি।’                                                                                                    -৬৫৬                                                                                                                                                          -‘পথহারা তুমি পথিক যেন গো সুখের কাননে,                                                                                                                 ওগো, যাও কোথা যাও।’                                                                                                                          -আচ্ছা আমায় বলুন তো আপনি ঢুকলেন কি করে?                                                                                                -‘আমি তো যেখানে খুশি যেতে পারি’ বলে পাঁচ-ছবার উধাও হয়ে, ঘরের বিভিন্ন জায়গায় প্রকট হয়ে নিজের ক্ষমতা দেখালেন।

আমি বুঝলাম সত্যি আমি ভাগ্যবতী সেই মহাপুরুষের দেখা পেয়েছি আমি। নারী হয়েও তাঁকে ষষ্ঠাঙ্গে প্রণাম করলাম।

– রবিঠাকুর তুমি…

-‘বলি একটা লিমিট আছে তো দিঠি! আমি অফিস থেকে ফিরে এলাম, তুমি এখনও ঘুমোচ্ছ?’

-আরে এখন তো বিকেল বেলা। আমি তবে এগুলো সব স্বপ্ন দেখলাম! ধুর! এতো ভালো স্বপ্ন কে দেখে! কেন দেখলাম এমন স্বপ্ন! দেখলাম যখন পুরো দেখলাম না কেন!