"খাঁচার পাখি ছিল সোনার খাঁচাটিতে
বনের পাখি ছিল বনে।
একদা কী করিয়া মিলন হল দোঁহে,
কী ছিল বিধাতার মনে।"
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দুই পাখি’ কবিতাটির এই ক’টি লাইনের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের ‘টু’-এর অদ্ভুত মিল খুঁজে পাওয়া যায়। একজন যে ‘সোনার খাঁচা’ তথা ঐশ্বর্য্যে মোড়া অট্টালিকায় থাকে। চতুর্দিকে তার বিবিধ কলের খেলনা ছড়ানো, যখন যেটা ইচ্ছা স্বেচ্ছাচারিতার সঙ্গে খেলনা গুলিকে ব্যবহার করতে পারে সে। অপরদিকে, আরেকজন যাকে ‘বনের পাখি’-র সঙ্গে তুলনা করা যায়, সে খোলা আকাশের তলায় বাঁশ-কাঠির তৈরি তীর-ধনুক, বাঁশি, ঘুড়ি তার খেলার সরঞ্জাম। বলা যায় সে প্রকৃতির সন্তান।
প্রকৃতপক্ষে, ১৯৬৪-১৯৭৩ সালের আমেরিকা-ভিয়েতনাম যুদ্ধ সম্মন্ধে ‘টু’ শর্ট ফিল্মটি একটি শান্তির বার্তা দেয়। শর্টফিল্মটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বহু চিহ্নিত নিদর্শন। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে,
ধনী শিশুটি অট্টালিকায় বন্দি থেকে এবং দরিদ্র শিশুটি খোলা আকাশের তলায় দাঁড়িয়ে দ্বন্দ্বতে মত্ত। এক্ষেত্রে, অট্টালিকা তথা সে সুরক্ষা-আচ্ছাদনে আচ্ছাদিত। অর্থাৎ যুদ্ধে নিযুক্ত সেই ধনী অপেক্ষাকৃত আত্মবিশ্বাসী দেশটিকে নির্দেশ করা হচ্ছে। আবার দরিদ্র বালকের চতুর্দিকে কোনো সুরক্ষা-আচ্ছাদন নেই। সে খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে দ্বন্দ্বে নিযুক্ত। অর্থাৎ এখানে যুদ্ধে অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশটিকে নির্দেশ করা হচ্ছে।
প্রকৃতপক্ষে খেলনা গুলি কি সত্যিই খেলনা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে? এক্ষেত্রে খেলনা গুলি সম্পূর্ণরূপে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। একে অপরকে খেলনারূপী অস্ত্র প্রদর্শনীতে দুই শিশু আসলে মত্ত। সিনেমার প্রথমে ধনী শিশুটি রীতিমতো একাকীত্বে এবং একঘেয়েমিতে ভোগে ঘর ভর্তি খেলনা থাকা সত্ত্বেও। সে বারংবার আগুন জ্বালিয়ে বেলুন ফাটায়। এর থেকে একটি ধ্বংসাত্মক মানসিকতারও প্রকাশ পাচ্ছে। তাছাড়াও খেলনা রোবটে চুইংগাম লাগিয়ে দেওয়া ইত্যাদি থেকে বোঝা যায় খেলনা গুলো প্রকৃতপক্ষে তার কাছে মূল্যহীন শুধুমাত্র দরিদ্র শিশুটিকে শায়েস্তা করার অস্ত্রবিশেষ।
অপরদিকে, দরিদ্র শিশুর সকল খেলনাই বাঁশকাঠির তৈরি। দু’জনের দ্বন্দ্বের মাঝে বারবারই কলের খেলনার কাছে বাঁশকাঠির খেলনা হেরে যায়। দরিদ্র শিশুটি ঢোল নিয়ে এসে বাজিয়ে দেখালে, ধনী শিশু একটি খেলনা আনে যাতে ঢোলটি বাজাচ্ছে একটি কলের বাঁদর। অর্থাৎ যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে, ধনী দেশ গুলি সদাসর্বদা তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলি থেকে আমদানীকৃত ‘ক্রীতদাস’ এনে কাজ করায়- এমন তুলনাও হতে পারে।
দ্বন্দ্ব-বিরতিতে ধনী শিশুটিকে একটি আপেল খেতে দেখা যায়। অর্থাৎ যুদ্ধে যারা প্রথম বিশ্বের দেশ তারা সমস্ত সুযোগ সুবিধার ফল ভোগী- এই তুলনাই করা হচ্ছে।
অবশেষে শান্তির বার্তা। সবশেষে বাঁশির বুনো সুরে চাপা পড়ে যায় সমস্ত কলের খেলনার আওয়াজ। এদিকে ধনী শিশুর খেলনার মতো আত্মবিশ্বাস ভেঙে পড়ে। সে বসে পড়ে অর্থাৎ লড়াই লড়ে যাওয়ার মনোবল সে হারায়।
"বনের পাখি বলে 'আকাশ ঘন নীল,
কোথাও বাধা নাহি তার'
খাঁচার পাখি বলে'খাঁচাটি পরিপাটি
কেমন ঢাকা চারিধার'"
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের’দুই পাখি’র এই লাইন দু’টি দিয়ে যদি ব্যাখ্যা করি, তবে এখানে একটি আত্মশ্লাঘার দ্বন্দ্ব-ও আসে। ধনী ও দরিদ্র শিশু উভয়েই নিজ নিজ ক্ষমতা, স্থান,কাল,পাত্র- ইত্যাদির প্রতি আত্মবিশ্বাসী। তার সঙ্গে এটি প্রকৃতি বনাম যন্ত্রপাতির দ্বন্দ্ব-ও বটে। দরিদ্র শিশুটি যদি প্রকৃতির প্রতিনিধি হয় তবে ধনী শিশুটি অত্যাধুনিক নকল ধী-শক্তি দ্বারা চালিত যন্ত্রপাতির প্রতিনিধি। অর্জিত কৃত্রিম ধী-শক্তির যন্ত্রচালনার দ্বারা প্রকৃতিকে যতো ভাবেই প্রভাবিত করার চেষ্টা করা যাক না কেন, অবশেষে প্রকৃতির জয় অনিবার্য। ঠিক যেমন শর্ট ফিল্মটিতে দেখানো হয়েছে, যখন সমস্ত খেলনায় দম দিয়ে ধনী শিশু নিজের ক্ষনিকের জয় উদযাপন করছে ঠিক সেই সময় দরিদ্র শিশুর বাঁশির সেই বুনো সুর, যন্ত্রপাতির আওয়াজ গুলিকে ছাপিয়ে গিয়েছ।
সবশেষে বলাইবাহুল্য, একটি ছায়াছবিতে পরিচালনায় সত্যজিৎ রায়ের নামটাই যথেষ্ট। তাঁর ভাবনাচিন্তা, পরিবেশন পদ্ধতিতে, তিনি অসামান্য, অনবদ্য। তাঁর সকল সিনেমার মতো ‘টু’-শর্ট ফিল্মটিও বিশ্বব্যাপী সাদরে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। শিল্প সবসময়ই ভাষার মতো মাধ্যম, যে মাধ্যমের দ্বারা বিশ্বের দরবারে বহু বার্তা দেওয়া সম্ভব। ঠিক সেই মতোই ‘টু’- শর্ট ফিল্মটি একটি নিজস্ব বার্তা বহন করে।
সাল-১৯৬৪, পরিচালনা, স্ক্রিন-প্লে, মিউজিক- সত্যজিৎ রায়। প্রযোজনা- এসসো ওয়ার্ল্ড থিয়েটার। সিনেমাটোগ্রাফি- সৌমেন্দু রায়, সম্পাদনা- দুলাল দত্ত। শর্ট ফিল্ম (সময়)- ১২মিনিট