আমার শহর, কলকাতা, Bengali, Flash Fiction, Kolkata

সেকাল-একাল

লাল পেড়ে শাড়ি, বেণীতে বাঁধা লাল ফিতে, ধর্মতলার সেই চঞ্চল রাস্তা ধরে হেঁটে চলেছি। সকালের কলকাতায় তখন চারিদিকে ব্যস্ততা, ব্যবসায়ীদের ভিড়। কোনো মতে দ্রুত পায়ে হাজার লোকের ভিড় পেছনে ঠেলে এগিয়ে চলেছি আমি। খুব দেরি হয়ে গেছে! এবার একটা ট্রাম না পেলেই নয়। ইংরেজদের হাত থেকে সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া এই শহরে তখনও মেয়েরা রক্ষণশীলতা থেকে স্বাধীনতা পায়নি। তাই এই পথ আমার একার। আমি একাই হেঁটে চলছি শত শত মানুষের ভিড় কাটিয়ে। ওয়েলিংটন পেরিয়ে এলাম, তবুও ট্রামের দেখা নেই। এবার দাঁড়িয়েই পড়লাম। ঘড়ির কাটা বলছে আটটা পঁয়তাল্লিশ। এখনই যদি ট্রাম না পাই তাহলে ন’টা পঁচিশের ক্লাসে ঢুকতে সত্যিই দেরি হবে।

সেই মেয়েটা পূর্বজন্মের কোনো এক সকালে, কলেজে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল। তখন সে অষ্টাদশী, বেথুন কলেজের ছাত্রী।

সেই একজনই আজও পঁয়তাল্লিশ নম্বর বাসের জন্যে অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে আছে। চিন্তিত মুখ, এইবার সে বেথুন নয় যাদবপুরের ছাত্রী। সত্যিই দেরি হয়ে যাচ্ছে, ক্লাস মিস হয়ে যায় যদি! অপেক্ষা আর অপেক্ষা সেই একই শহরের অলি-গলি-রাজপথ জুড়ে শুধু অপেক্ষারা নিজেদের লক্ষ্যের দিকে চেয়ে থাকে। কখন আরেকটিবার সন্ধ্যে হবে। তারপর আবার ভোর। আমি আবার নতুন করে জন্মাবো তখনও এই শহরেই। শহরটাকে নতুন করে জানবো বলে। নতুন করে ভালোবাসবো বলে। আমি আদতে যে বড্ডো বাঙালি। তাই অপেক্ষার পর অপেক্ষা করে বারবার ফিরে আসি এই শহরের হৃদয়েই।

ছবি কৃতজ্ঞতা- google ছাড়া আর কে-ই বা হতে পারে।

#২১শে ফেব্রুয়ারি, Awareness, আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস, Philosophy

বাংরেজআর মাতৃভাষা

বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছি সঙ্গে আছে এক সহপাঠী। স্বভাবতই টুকটাক কথা বলছি আমরা। সে থাকে তেঘরিয়া। চোখের সামনে দিয়ে একটা ফাঁকা মিনিবাস দিব্যি বেরিয়ে গেল তার কোনো হুশ নেই।
আমি বললাম, ‘কিরে গেলি না?’
সে বললো ‘বাস কই!’
আমি বললাম এই তো চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল!
অমনি আঁতকে উঠে সে বলল,’ কই কন্ডাকটর তো চেঁচালো না! ওউউ শিট! ওটা তেঘরিয়ার বাস ছিল! আসলে আমি বাংলাটা পড়তে পারি না তো তাই বাসটার গায়ে যে তেঘরিয়া লেখা সেটা পড়তে পারিনি রে!’

কিছুতো করার নেই! একটা দেখানি কান এঁটো করা হাসি তো হাসতেই হবে! মনে মনে ভাবছিলাম ইচ্ছে করে বিচুটিপাতা গুঁড়ো কাগজে তাল পাকিয়ে এদের দিকে টিপ করে গুলতি দিয়ে ছুড়ি! বাংরেজের দল!

সেবার একটি প্রজেক্টের জন্য স্ক্রিপ্ট লিখেছিলাম। আমায় একজন এসে বললে,’বাংলা পড়তে পারি না রে বাংলাটা একটু ইংরেজিতে লিখে দিবি?’

এদের কিছু বলতে পারা যায় না। কী বা বলতে পারি আমরা! ভাষার জন্য ভালোবাসা মানুষের অন্তরের থেকে আসার কথা। সেই অনুভূতি তো মানুষকে শেখানো সম্ভব নয়। ক্রমাগত ভেবে চলা ইংরেজিটা বেশি ভালো, গ্রহণযোগ্যতা বেশি। সেই ভেবে মনের মধ্যে হীনমন্যতা পুষে রেখে নিজের ঐতিহ্যকে অগ্রাহ্য করা। হতে পারে ইংরেজি দাপ্তরিক গ্রহণযোগ্যতা রাখে। কিন্তু আমরা বাঙালিরা তো বাংলায় কাঁদি, বাংলায় হাসি তাই বাংলাটা হৃদয়ে থাক, বেঁচে থাক❤️।

Social Issues

পবিত্রস্থান

একটা দরজা। অনেক বড়ো দরজাটা। দরজার উপরে লেখা ‘পবিত্রস্থান’। ভিতরে ঢুকলাম। একটা বড়ো উঠোন। উঠোন পেরোলে কতগুলো বড়ো বড়ো সেক্টর। একটা সেক্টরে বসে আছেন হিন্দু কোনো দেবদেবী। পরের সেক্টরে নামাজ পড়া হচ্ছে। আরেকটি সেক্টর থেকে ভেসে আসছে, ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি’। কোনো সেক্টরে বা দাঁড়িয়ে আছেন প্রভু যীশু। ঐ একই উঠোনে এইরকম আরও অনেক সেক্টর আছে- ভারতবর্ষে যতগুলো ধর্ম আছে ততগুলো সেক্টর। – আমরা তো এই ভারতবর্ষ-ই দেখতে চেয়েছিলাম তাই না?

সেইদিন যেদিন রামজন্মভূমি দখল করেছিলেন বাবর, তুলেছিলেন মসজিদ- সেদিন আদৌ কী আল্লাহ এসেছিলেন সেই মসজিদে? আজ একই ভাবে মসজিদ ভেঙে মন্দির গড়া হলো। কাটা পড়লো অনেকের বাসস্থান- এইভাবেই কি খুশি হন পুরুষোত্তম, প্রজাপ্রিয় শ্রীরাম?

যদিও সরকারের কাজ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, কর্মসংস্থান ইত্যাদি ইত্যাদি দিকে নজরপাত করা। কে বাড়িতে নামাজ পড়বে, পুজো করবে সে তো জনতার ব্যক্তিগত জীবন। আমার স্পিরিচুয়ালিটি কী বলে, কোন ধর্মের নৈতিকতা আমায় আকর্ষণ করে সে তো একান্তই আমার সিদ্ধান্ত। স্ট্যাচু অফ ইউনিটি গড়া হলো, রামমন্দির গড়া হলো। সঙ্গে আমরা বড়ো বড়ো অঙ্কও শিখলাম! তবে তাতে আমাদের কিছু যায়-আসে না। কারণ আমরা মাথা উঁচু করে দেখতে চাই সোনার ঘড়া আর স্ট্যাচু অফ ইউনিটি! ঠিক তার পাশেই বিস্তৃত আছে কতগুলো এঁদো, বস্তিতে ঘেরা গলিপথ। সেই বস্তিতে কোনো শিশু পড়তে বসে, কেউ বা বসে না। কারোর উনুন জ্বলে কারোর বা ভাত জোটে না। হ্যাঁ হ্যাঁ প্রদীপের তলায় ঐ যেখানে অন্ধকার পড়েছে সেই জায়গাটা। কী অন্ধকার না? সত্যিই কিছুই দেখা যায় না!

Bengali, Book Review, Review

গাধা

বায়োলজিক্যাল দিক থেকে দেখতে গেলে গাধার ব্রেইনের সঙ্গে মানুষের ব্রেইনের মিল নেই… কিন্তু তবু, ছোট থেকে বড়ো হতে হতে, বড়ো থেকে বুড়ো হতে হতে- এ এক অদ্ভুত কমপ্যারিসন যেটা আমাদের সকলকেই টুক টাক হজম করতে হয় ! এর মূল কারণ প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব। অর্থাৎ উপস্থিতবুদ্ধি প্রয়োগের ক্ষমতা। একটা ছোট্ট সিদ্ধান্ত যে কতো ভাবে জীবন পাল্টে দিতে পারে, পরিস্থিতি যে কীভাবে একটা মানুষকে ‘গাধা’-ভূষণে ভূষিত করতে পারে। সেই নিয়ে হলো এই বইটি। বাপ রে। ঠিক সিদ্ধান্তে তুমি রাজা, আর ভুল সিদ্ধান্তে এক্কেবারে ড্রেনে পড়ে যাওয়া গাধা! পড়তে পড়তে সত্যিই মনে হলো, আমরা পরিস্থিতির দাস, নিজের চলন শক্তির দাস। পান থেকে চুন খসলেই পরিস্থিতির কাছে আমরা বিদ্রুপের খোরাক হই। পরিস্থিতি নামের আয়নাটা আমাদের চেহারার প্রতিফলনে একটা গাধার ছবি দেখায়।

Analysis, Anti-war, Bengali, Review

টু

"খাঁচার পাখি ছিল  সোনার খাঁচাটিতে
বনের পাখি ছিল বনে।
একদা কী করিয়া মিলন হল দোঁহে,
কী ছিল বিধাতার মনে।"

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দুই পাখি’ কবিতাটির এই ক’টি লাইনের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের ‘টু’-এর অদ্ভুত মিল খুঁজে পাওয়া যায়। একজন যে ‘সোনার খাঁচা’ তথা ঐশ্বর্য্যে মোড়া অট্টালিকায় থাকে। চতুর্দিকে তার বিবিধ কলের খেলনা ছড়ানো, যখন যেটা ইচ্ছা স্বেচ্ছাচারিতার সঙ্গে খেলনা গুলিকে ব্যবহার করতে পারে সে। অপরদিকে, আরেকজন যাকে ‘বনের পাখি’-র সঙ্গে তুলনা করা যায়, সে খোলা আকাশের তলায় বাঁশ-কাঠির তৈরি তীর-ধনুক, বাঁশি, ঘুড়ি তার খেলার সরঞ্জাম। বলা যায় সে প্রকৃতির সন্তান।

প্রকৃতপক্ষে, ১৯৬৪-১৯৭৩ সালের আমেরিকা-ভিয়েতনাম যুদ্ধ সম্মন্ধে ‘টু’ শর্ট ফিল্মটি একটি শান্তির বার্তা দেয়। শর্টফিল্মটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বহু চিহ্নিত নিদর্শন। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে,

ধনী শিশুটি অট্টালিকায় বন্দি থেকে এবং দরিদ্র শিশুটি খোলা আকাশের তলায় দাঁড়িয়ে দ্বন্দ্বতে মত্ত। এক্ষেত্রে, অট্টালিকা তথা সে সুরক্ষা-আচ্ছাদনে আচ্ছাদিত। অর্থাৎ যুদ্ধে নিযুক্ত সেই ধনী অপেক্ষাকৃত আত্মবিশ্বাসী দেশটিকে নির্দেশ করা হচ্ছে। আবার দরিদ্র বালকের চতুর্দিকে কোনো সুরক্ষা-আচ্ছাদন নেই। সে খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে দ্বন্দ্বে নিযুক্ত। অর্থাৎ এখানে যুদ্ধে অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশটিকে নির্দেশ করা হচ্ছে।

প্রকৃতপক্ষে খেলনা গুলি কি সত্যিই খেলনা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে? এক্ষেত্রে খেলনা গুলি সম্পূর্ণরূপে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। একে অপরকে খেলনারূপী অস্ত্র প্রদর্শনীতে দুই শিশু আসলে মত্ত। সিনেমার প্রথমে ধনী শিশুটি রীতিমতো একাকীত্বে এবং একঘেয়েমিতে ভোগে ঘর ভর্তি খেলনা থাকা সত্ত্বেও। সে বারংবার আগুন জ্বালিয়ে বেলুন ফাটায়। এর থেকে একটি ধ্বংসাত্মক মানসিকতারও প্রকাশ পাচ্ছে। তাছাড়াও খেলনা রোবটে চুইংগাম লাগিয়ে দেওয়া ইত্যাদি থেকে বোঝা যায় খেলনা গুলো প্রকৃতপক্ষে তার কাছে মূল্যহীন শুধুমাত্র দরিদ্র শিশুটিকে শায়েস্তা করার অস্ত্রবিশেষ।

অপরদিকে, দরিদ্র শিশুর সকল খেলনাই বাঁশকাঠির তৈরি। দু’জনের দ্বন্দ্বের মাঝে বারবারই কলের খেলনার কাছে বাঁশকাঠির খেলনা হেরে যায়। দরিদ্র শিশুটি ঢোল নিয়ে এসে বাজিয়ে দেখালে, ধনী শিশু একটি খেলনা আনে যাতে ঢোলটি বাজাচ্ছে একটি কলের বাঁদর। অর্থাৎ যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে, ধনী দেশ গুলি সদাসর্বদা তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলি থেকে আমদানীকৃত ‘ক্রীতদাস’ এনে কাজ করায়- এমন তুলনাও হতে পারে।

দ্বন্দ্ব-বিরতিতে ধনী শিশুটিকে একটি আপেল খেতে দেখা যায়। অর্থাৎ যুদ্ধে যারা প্রথম বিশ্বের দেশ তারা সমস্ত সুযোগ সুবিধার ফল ভোগী- এই তুলনাই করা হচ্ছে।

অবশেষে শান্তির বার্তা। সবশেষে বাঁশির বুনো সুরে চাপা পড়ে যায় সমস্ত কলের খেলনার আওয়াজ। এদিকে ধনী শিশুর খেলনার মতো আত্মবিশ্বাস ভেঙে পড়ে। সে বসে পড়ে অর্থাৎ লড়াই লড়ে যাওয়ার মনোবল সে হারায়।

"বনের পাখি বলে 'আকাশ ঘন নীল,
কোথাও বাধা নাহি তার'
খাঁচার পাখি বলে'খাঁচাটি পরিপাটি
কেমন ঢাকা চারিধার'"

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের’দুই পাখি’র এই লাইন দু’টি দিয়ে যদি ব্যাখ্যা করি, তবে এখানে একটি আত্মশ্লাঘার দ্বন্দ্ব-ও আসে। ধনী ও দরিদ্র শিশু উভয়েই নিজ নিজ ক্ষমতা, স্থান,কাল,পাত্র- ইত্যাদির প্রতি আত্মবিশ্বাসী। তার সঙ্গে এটি প্রকৃতি বনাম যন্ত্রপাতির দ্বন্দ্ব-ও বটে। দরিদ্র শিশুটি যদি প্রকৃতির প্রতিনিধি হয় তবে ধনী শিশুটি অত্যাধুনিক নকল ধী-শক্তি দ্বারা চালিত যন্ত্রপাতির প্রতিনিধি। অর্জিত কৃত্রিম ধী-শক্তির যন্ত্রচালনার দ্বারা প্রকৃতিকে যতো ভাবেই প্রভাবিত করার চেষ্টা করা যাক না কেন, অবশেষে প্রকৃতির জয় অনিবার্য। ঠিক যেমন শর্ট ফিল্মটিতে দেখানো হয়েছে, যখন সমস্ত খেলনায় দম দিয়ে ধনী শিশু নিজের ক্ষনিকের জয় উদযাপন করছে ঠিক সেই সময় দরিদ্র শিশুর বাঁশির সেই বুনো সুর, যন্ত্রপাতির আওয়াজ গুলিকে ছাপিয়ে গিয়েছ।

সবশেষে বলাইবাহুল্য, একটি ছায়াছবিতে পরিচালনায় সত্যজিৎ রায়ের নামটাই যথেষ্ট। তাঁর ভাবনাচিন্তা, পরিবেশন পদ্ধতিতে, তিনি অসামান্য, অনবদ্য। তাঁর সকল সিনেমার মতো ‘টু’-শর্ট ফিল্মটিও বিশ্বব্যাপী সাদরে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। শিল্প সবসময়ই ভাষার মতো মাধ্যম, যে মাধ্যমের দ্বারা বিশ্বের দরবারে বহু বার্তা দেওয়া সম্ভব। ঠিক সেই মতোই ‘টু’- শর্ট ফিল্মটি একটি নিজস্ব বার্তা বহন করে।

সাল-১৯৬৪, পরিচালনা, স্ক্রিন-প্লে, মিউজিক- সত্যজিৎ রায়। প্রযোজনা- এসসো ওয়ার্ল্ড থিয়েটার। সিনেমাটোগ্রাফি- সৌমেন্দু রায়, সম্পাদনা- দুলাল দত্ত। শর্ট ফিল্ম (সময়)- ১২মিনিট

২২ শে শ্রাবণ, Bengali, Review

‘বাইশে শ্রাবণ’

পরিচালনা, গল্প, চিত্রনাট্য- সৃজিত মুখোপাধ্যায়, প্রযোজনা- শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মস, অভিনয়- প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, রাইমা সেন, আবির চট্টোপাধ্যায়, গৌতম ঘোষ প্রমুখ। সুরকার (মিউজিক কম্পোজার)- অনুপম রায়, মুক্তি পায়- ৩০ শে সেপ্টেম্বর’১১।

-‘হুইস্কি চলে?’

-‘না’

-‘বর্নভিটা?’

-‘না। ধন্যবাদ।’

আপাতদৃষ্টিতে দেখলে চরিত্রটি এতোটাই ব্যঙ্গপূর্ণ কথা ছুড়ে দিতে পারেন বাকি চরিত্র গুলোর দিকে। প্রতিটি পদেপদে নিজের কঠোরতা, রূঢ়তা, ঔদ্ধত্য, আত্মঅহংকার উগরে দিতে চান। আসলে এই প্রত্যেকটা নেতিবাচক শব্দই চরিত্রটির একটি বিষয়ের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত- হতাশা। চরিত্রের নাম প্রবীর রায় চৌধুরী। সিনেমাটি দেখলেই বোঝা যায় প্রবীরবাবুর চেহারা, মন এমন কি বাড়িটারও একই অবস্থা- ভগ্ন, জীর্ণ- জর্জরিত, প্রাণহীন, শুধু যেন কাঠামোটা দাঁড়িয়ে আছে। প্রবীরবাবু একজন সারাজীবনের মতো সাসপেন্ডেড হওয়া পুলিশ অফিসার। অতিরিক্ত রাগ, আসামীদের নিজস্ব শত্রু বলে মনে করা, কয়েদিদের মারতে মারতে মেরে ফেলা, এই কারণেই তিনি সাসপেন্ডেড। তবু তাঁর জ্ঞান, বুদ্ধির জন্য সে পুলিশ অফিসার হিসাবে ভারতবর্ষের অন্যতম।

নির্দিষ্ট একটি মোটিভ বজায় রেখে শহরে ঘটে চলেছে একটার পর একটা খুন। সেই খুনের মোটিভ অনুসারে নামকরণ করা হয়েছে ‘বাইশে শ্রাবণ’। সেই দিক থেকে নামকরণটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। নিপুণতা ও দক্ষতার সঙ্গে শব্দ দিয়ে চিত্রনাট্য বুনেছেন সৃজিত মুখার্জী। পরিচালনা ও চিত্রনাট্যের দিক থেকে দেখতে গেলে সৃজিত মুখার্জী নিঃসন্দেহে অসাধারণ। তার সাথে রয়েছে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, গৌতম ঘোষ, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, রাইমা সেন, আবির চট্টোপাধ্যায়-দের মতো সুদক্ষ অভিনেতা, অভিনেত্রীদের অভিনয়। তাঁরা যে যাঁর চরিত্রে অনবদ্য। বিশেষ কিছু সংলাপ পরিবেশনা দর্শকদের ভীষণভাবে মন কেড়েছে। গৌতম ঘোষ অভিনীত পাগলা কবির চরিত্রের মাধ্যমে বিশেষ ভাবে কিছু কবিদের হাঁড়ির হাল তুলে ধরা হয়েছে। সিনেমায় ব্যবহৃত অনুপম রায়ের কম্পোজিশন, ‘একবার বল’, ‘যে ভাবে জলদি হাত’- ইত্যাদি ব্যবহৃত প্রতিটি গান-ই দর্শকের মন ছুঁয়ে গিয়েছে।

মাঝখানে রয়েছে অভিজিৎ পাকরাশী (পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়) ও অমৃতা (রাইমা সেন)-এর ছোট্ট একটি প্রেমের গল্প। প্রেমের গল্পটি সিনেমার মূল গল্পের সাথে সমান্তরালে বহমান। সেটি দর্শকদের মন কেড়েছে।

সব মিলিয়ে সাইকোলজিক্যাল থ্রিলারটি তৎকালীন বাংলা চলচ্চিত্রের গতনুগতিকতা ভেঙে দর্শকের মনে এনে দেয় এক অন্যরকমের বৈচিত্রতা। ছায়াছবির মূল গল্পটি মূলত ‘সেভেন’ (১৯৯৫) এবং ‘রাইটেয়াস কিল’ (২০০৮) থেকে নেওয়া হয়েছে।

সব মিলিয়ে সিনেমাটি অবশ্যই মনোগ্রাহী। সব মিলিয়ে সিনেমাটি পরিপূর্ণতা পেয়েছে। সিনেমার শেষে রয়েছে সব চেয়ে বড়ো ট্যুইস্ট।’বাইশে শ্রাবণ’ মুক্তি পাওয়ার প্রায় নয় বছর পর ‘বাইশে শ্রাবণ’-এর দ্বিতীয় পর্ব হিসেবে মুক্তি পায় ‘দ্বিতীয় পুরুষ’।

আমার শহর, উত্তর কলকাতার পুরোনো বাড়ি, কলকাতা, Bengali, Kolkata, My City, Social Issues

শহর হারিয়ে যায় শহরের গর্ভেই

‘ইঁটের টোপর মাথায় পরা শহর কলকাতা।’ কলকাতা বরাবরই ইঁটের টোপর পরিহিত, সিমেন্টের ধূসর জঙ্গল। তবু উত্তর কলকাতার ইঁট-পাথরের বড়ো-বড়ো পুরোনো বাড়ি আর কুহেলী-কমলা হ্যালোজেনের আলোর মাঝে, আমরা হারিয়ে যেতে ভালোবাসি অলিগলি থেকে রাজপথে।

দেড়শো বছর আগে এই রাস্তাগুলিতেই দৌড়ে যেতো শত ঘোড়ার গাড়ি, জমিদার বাড়ির অন্দর থেকে ভেসে আসতো কোলাহল, সিংহদুয়ারে জ্বলতো ঝকঝকে দাপুটে মশাল। আজ সেই মশালের আলো, বন্দি হয়ে যাচ্ছে ফ্ল্যাটবাড়ির ছোট খোপ-ঘরে। স্থবির, বৃদ্ধ, বড়ো বাড়ি গুলি হয়ে যাচ্ছে একা। কখনও বা কোনো কোনো বাড়ির একটি ঘরে ফেড হওয়া পর্দার ফাঁক দিয়ে দুলতে থাকে আবছা আলো। তবু বেশিরভাগই আজ ভগ্নপ্রায়। বড়ো-বড়ো বাড়ির মালিকরা ছেড়ে চলে যাচ্ছে বাড়ি গুলিকে। আবার সেই পরিত্যক্ত বাড়িগুলি চলে যাচ্ছে প্রমোটারের হাতে। বাড়িগুলির সাথে সাথে ভাঙছে অনেক স্মৃতি, অনেক গল্প, আর গুচ্ছ-গুচ্ছ ইতিহাস। আর কলকাতা পাল্টে যাচ্ছে কলকাতার যাদুতেই।

সম্প্রতি, পরিচালক অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় এই নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পোস্ট করেন। তাঁর কথায়, ” ওপেন- টি- বায়োস্কোপে’- এর বৈশাখী ফোয়ারার বাড়িটি শ্যুটিং-এর পরপরই ভেঙে দেওয়া হয়েছিলো। এখন সেখানে চারতলা ফ্ল্যাটবাড়ি। এবার ভাঙা পড়লো কন্দর্পনারায়ণের রাজবাড়ি। ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ির’ শ্যুটিং হয়েছিলো এই মহিষাদলের পুরোনো রাজবাড়িটিতে। বাড়ির নীচের এক প্রকোষ্ঠে একদা বাঘ থাকতো এ বাড়িতে। একরাত শ্যুটিং করেছিলাম এখানে। অনেক স্মৃতি জড়িয়ে ছিলো এর সঙ্গে। তারও কিছু মনে পড়লো বই কি! একটার পর একটা বাড়ি ভাঙে, আর অনেক গুলো মন।’ ”মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’র শ্যুটিং হওয়া রাজবাড়িটির সাথে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাসটিতে দেওয়া রাজবাড়িটির বর্ণনার সাথে অদ্ভুত ভাবে মিলে যায়। তবু ভেঙে পড়ে সমস্ত স্মৃতি।’

তবে, প্রশ্ন শুধুই কি আমাদের নস্টালজিয়ায় আটকে থাকে, কলকাতার এই পুরোনো ইন্দো-ইউরোপিয়ান স্টাইলের বাড়িগুলিকে ঘিরে থাকে বড়ো-বড়ো প্রশ্ন। বাড়ি গুলির মধ্যে বন্দি কলকাতার ঐতিহাসিক ঐতিহ্য। এই পেল্লাই বাড়িতেই সেই পুরোনো দিন গুলি থেকে বেড়েছে ভাগীদারের সংখ্যা। বাড়িগুলিকে নিজেদের মতো করেই ছোট-ছোট ভাগে বিভক্ত করেছেন তারা। কেউ কেউ বা বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। যারা থাকেন তাদের আবার মাঝে মাঝেই ভূসম্পত্তিগত বিবিধ সমস্যার সম্মুখিন হতে হয় পৌরসভার কাছে। এতো সমস্যার সম্মুখিন হতে না চেয়ে বেশিরভাগ বাড়ির মালিকেরাই তাদের বড়ো বাড়িটি, শত বছরের ইতিহাসের সাক্ষীটিকে তুলে দেন প্রমোটারের হাতে। এই ভাবেই ধূসর শহরে হারিয়ে যায় কয়েকটা ইতিহাস।

হলুদ ট্যাক্সির জানলা দিয়ে দেখা যায় চলন্ত ঐ সবুজ বাড়িটা আর তার পাশের লাল কৃষ্ণচূড়া গাছটা। চলন্ত ট্যাক্সি থেকে দু’টি-কে একসাথে দেখে যেন মনে হয় একটা ছটফটে টিয়াপাখি যেন উড়ে যাচ্ছে।

দশ বছর পর এখন টিয়ারঙা বাড়িটা আর নেই, কৃষ্ণচূড়ার গাছের বদলে সেখানে কেবল পাতা কতোগুলো চেয়ার-টেবিল। সবুজ বাড়ির বদলে দাঁড়িয়ে আছে একটা আলো ঝলমলে ক্যাফেটেরিয়া। ক্যাফেটেরিয়ার কাচের ভিতরে কতোজন আবেগে ভাসমান মানুষ, যারা কোনোদিনও জানতেই পারেনি ঐ টিয়াপাখিরঙা বাড়ি আর কৃষ্ণচূড়া গাছটার কথা। এইভাবেই শহর পুরোনো পোশাক বদলে ফেলে। এইভাবেই শহর জীবন্ত থাকে।

Life, Nature

‘ভয় পেয়েছো সত্যি কি? দেখছো আমায় আদৌ কি?’

ঐ দূরের কুয়াশা ঘেরা প্রান্তরের শেষ প্রান্তে,নিজের সঙ্গে নিজে বুনো ভাষায় কথা বলতে বলতে একটা সরু,সাদা ফিতের মতো নদী হেঁটে চলেছে দক্ষিণের পথে।
এখনো পর্যন্ত ওকে কেউ নাম জিজ্ঞেস করেনি,তাই ওর নাম জানে না কেউ-ই।
ওর প্রাণে বুঝি ভয় নেই! দিব্যি যে একা একা ছোট্ট মেয়েটার মতো আপনমনে বকতে-বকতে এগিয়ে চলেছে!
আমি তার সেই বুনো ভাষা বুঝি না।
শান্ত কুয়াশার জাজিম জড়িয়ে ধরে রেখেছে সেই থমথমে মুখওয়ালা আকাশ-ছোঁয়া গাছেদের গুড়ির দলকে।
বিশাল পাতাগুলোর ফাঁক দিয়ে আসা অল্প রোদের গা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে সন্ধ্যা।
রয়েছি যেনো প্রকৃতির মায়া জগতে।
পায়ের তলায় ঝরাপাতার ভিড়ে পা হারিয়ে যাচ্ছে কখনো-সখনো।
চলতে-চলতে ফিরে আসছি একই পথে আর কোনো-কোনো বুড়ো পাতা কানের পাশ দিয়ে ঝরে যেতে-যেতে শাসিয়ে উঠছে দু-এক কথায়,’আস্তে! এখানে শহুরে প্রাণীদের কথা বলা বারণ, আসতে নেই এখানে তাদের!’
আমি, ‘শহুরে প্রাণী’ সত্যি তো! নিরন্তর আমার হৃদপিণ্ডের প্রকোষ্ট থেকে নিসৃত হয় আতরমাখা শহুরে গন্ধ! কি করবো! কোথায় যাব! এতো বিরাট প্রকৃতি, আমি তার মধ্যে কেবল বেমানানসই শহুরে এক কণা!
সন্ধ্যার ঘন নীল রঙ আমার শরীরে বাধা পাচ্ছে।
অজানা ভয় আমার সারা শরীর জুড়ে চেপে বসেছে।
ইচ্ছা করছে একবার প্রাণপণে চিৎকার করি!
কিসের আতঙ্ক আমার! বৃহদতার আর ক্ষুদ্রতার মাঝে কতোখানি দূরত্ব সেই পরিমাণটা বুঝে ফেলার জন্যে আতঙ্ক?
হঠাৎ নিরক্ষর বুনো হাওয়া বইতে শুরু করেছে দুর্ধর্ষ গতিতে, দূরের নদীটা যেনো এবার বুনো ভাষায় গান জুড়েছে। বিশালাকার বৃক্ষ গুলো সেই বুনো সঙ্গীত গায়ে মেখে, কায়ায় দোলা লাগিয়ে তান্ডব নৃত্যে মেতে উঠেছে, দূর বহু দূর থেকে ভেসে আসছে উচ্ছসিত ডাহুকের ডাক। তার মাঝেই, হঠাৎ জগতে ধ্বনিত হচ্ছে দুটো বাক্য, ‘ভয় পেয়েছো সত্যি কি? দেখছো আমায় আদৌ কি?’

Philosophy

সময়ের বিড়ালছানা

এই নিস্তব্ধতাকে হৃদপদ্মে সযত্নে আঁকড়ে ধরে।
সময়ের বিড়ালছানার খেলা দেখি।
লেজ তুলে বেপরোয়া চিত্তে সে একা একা খেলে বেড়ায়। আমি দাঁড়িয়ে দেখি।
আর আমাকে দোলা দিয়ে যায় ছোটবেলার সেই পুরোনো নরম ঠান্ডা হাওয়া। যতবার দোলা দেয়, আমি ভাবি আমার শরীর বুঝি হাওয়ায় মিশে যাচ্ছে।
হাওয়ার মধ্যে সেই স্নিগ্ধতা, সেই ছোটবেলার মিঠে গন্ধ। সময়ের বিড়ালছানা খেলে চলে। আর আমি, সেই হাওয়ায় ভেসে ভেসে ছোটবেলায় ফিরতে চাই।

আমি ছোটবেলার গাছেদের সাথে কথা বলি,
গান শোনাই। ওরা আমার কথা শোনে,
গান শোনে আর সময়ের বিড়ালের সাথে তাল মিলিয়ে লম্বা হয়।

আমি ওদের মতো কখনো চাইনি সময়ের বিড়ালের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে।
তবু চলি, চলতে হয় তাই।

একদিন সেই গাছেরাও বুড়ো হবে।
আর আমি ঐ একইরকম ভাবে হাওয়ার মধ্যে
যৌবনের আতরঢালা সুগন্ধ খুঁজতে-খুঁজতে,
খুঁজতে-খুঁজতে সময়ের বিড়ালছানাকে কোলে তুলে,
বেরিয়ে পড়বো নতুন কোনো শৈশবের সন্ধানে।

Philosophy

মনোবৃক্ষ

পায়ের আঙুল গুলো বেঁকে যেতে যেতে, ক্রমশ বাদামি রঙের শিকড়ে পরিণত হচ্ছে। মাটি কামড়ে ধরছে ক্রমশ। ধরিত্রী থেকে শুষে নিচ্ছে রস। খাদ্যগ্রহণের মাধ্যম বদলাচ্ছে আমার।
হাতের আঙুল গুলো বেড়ে যেতে যেতে, বিস্তার করছি শাখা-প্রশাখা। কোনো কোনো অংশ থেকে জন্মেছে পাতা।
মিশমিশে কালো কেশ, গাঢ় থেকে হালকা সবুজে পরিণত হচ্ছে।
সূর্যের আলোর দিকে তাকিয়ে সালোকসংশ্লেষ করতে শিখছি আমি। আর আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখছি, নানান চরিত্রের মেঘ। তারা হেসে-ভেসে চলে যাচ্ছে। আমি ছুঁতে পারিনা তাদের। কিছু মেঘ, বৃষ্টি হয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে আমার শরীর, তবু মনকে তারা ছোঁয়ার চেষ্টা করে না।
হয়তো আমি মানুষ থেকে ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছি বৃক্ষে।
তাবলে, বৃক্ষের বুঝি মন থাকতে নেই!